
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়ে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার সম্পর্ককে আরও গভীর ও ভবিষ্যতমুখী কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দুই নেতা প্রথমে একান্ত বৈঠক করেন, তার আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সীমিত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অভিবাসন, জ্বালানি সহযোগিতা, নীল অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিস্তৃত দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় নেতৃত্ব দেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দুই দেশ ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহানুভূতির ওপর ভিত্তি করে একটি গভীর বন্ধন রয়েছে। মালয়েশিয়া আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বিশেষত মানবসম্পদ ও বাণিজ্য খাতে।
আনোয়ার ইব্রাহিম ড. ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য বৃদ্ধি ও অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণ, শিক্ষা ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
বৈঠকে ড. ইউনূস মালয়েশিয়াকে প্রোটোকলের আওতায় আটকে পড়া প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া এবং একাধিকবার প্রবেশের ভিসা চালুর জন্য ধন্যবাদ জানান। যার ফলে জরুরি পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা তাদের চাকরির ঝুঁকি না নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবেন।
বৈঠকে উভয়পক্ষ ব্যয় হ্রাস ও শ্রমিক কল্যাণ রক্ষার জন্য স্বচ্ছ ও ন্যায্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন।
প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় আইন, বিচার ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জিটুজির আওতায় চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ আরও দক্ষ বাংলাদেশি পেশাদারদের নিয়োগের জন্য মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ দক্ষ পেশাজীবীদের সরকারি পর্যায়ে নিয়োগের সুযোগ বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া প্রবাসে কর্মরত অনিয়মিত বাংলাদেশিদের বৈধতার আওতায় আনার অনুরোধ জানান আসিফ নজরুল।
মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশি কর্মীরা এখন থেকে স্থানীয়দের মতোই সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন এবং বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
তাছাড়া বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট পাস’ ভিসা দেওয়ার অনুরোধ করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।
বৈঠকে দুই নেতা আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার মর্যাদার প্রচেষ্টা ও আসিয়ানের সভাপতিত্বের সময় মালয়েশিয়ার সমর্থন চেয়েছেন।
ড. ইউনূস মালয়েশিয়াকে কক্সবাজারে আসন্ন রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক সম্মেলন ও সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদ জানান।
অর্থনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ত্বরান্বিত করতে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করতে এবং মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ যৌথ ব্যবসা পরিষদ কার্যকর করতে সম্মত হয়েছে।
দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কথা তুলে ধরে ঢাকা মালয়েশিয়ার বাজারে ওষুধ, ব্যাটারি, পাদুকা, সিরামিক এবং পাটের মতো বাংলাদেশি পণ্যের জন্য বৃহত্তর বাজার প্রবেশাধিকার চেয়েছে।
দু’দেশ এলএনজি সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতার ওপর একটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি অংশীদারিত্ব অন্বেষণেও উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে। তারা প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি ও পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ এশিয়ার খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেন।
এর আগে পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে ড. ইউনূসকে গার্ড অব অনার দিয়ে লাল গালিচায় স্বাগত জানানো হয়।
পরে দুই নেতার উপস্থিতিতে একাধিক সমঝোতা স্মারক সই হয়। যার মধ্যে ছিল প্রতিরক্ষা, এলএনজি সরবরাহ, কৌশলগত গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ, হালাল শিল্প ও উচ্চশিক্ষা সহযোগিতা। উভয়পক্ষ কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ, হালাল শিল্প সহযোগিতা ও উচ্চশিক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে নোট বিনিময়ও করেন।
এদিকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধান উপদেষ্টার সম্মানে একটি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০০:৩২ ৩ বার পঠিত